প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক লোন নিয়ম ২০২৫
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের অবদান অনস্বীকার্য। দেশের এই সূর্য সন্তানদের বিদেশ যাত্রার পথ সুগম করতে এবং বিদেশ ফেরত কর্মীদের দেশে আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে একটি বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠান—প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক।
এই ব্যাংকের মূল উদ্দেশ্যই হলো স্বল্প সুদে এবং সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে প্রবাসীদের আর্থিক সহায়তা করা। কিন্তু অনেকেই সঠিক তথ্য ও নিয়মাবলী না জানার কারণে এই দারুণ সুযোগটি গ্রহণ করতে পারেন না।
আজকের এই আর্টিকেলে আমরা ২০২৫ সালের সর্বশেষ এবং সম্পূর্ণ নিয়মাবলী নিয়ে আলোচনা করব, যেন আপনি খুব সহজেই প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে লোন পেতে পারেন।
- আরও পড়ুনঃ সোনালি ব্যাংক লোন
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক কী ধরনের লোন প্রদান করে?
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক মূলত দুই শ্রেণীর কর্মীদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ঋণ বা লোন প্রদান করে থাকে:
১. অভিবাসন ঋণ: যারা নতুন করে বিদেশ যেতে চান, তাদের জন্য। ২. পুনর্বাসন ঋণ: যারা বিদেশ থেকে ফিরে এসে দেশে কোনো ব্যবসা বা প্রকল্প শুরু করতে চান, তাদের জন্য।
আসুন, এই দুটি লোনের নিয়মাবলী, যোগ্যতা এবং আবেদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।
- আরও পড়ুনঃ ডাচ বাংলা ব্যাংক লোন
বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীদের জন্য ঋণ (অভিবাসন ঋণ)
যারা প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে বিদেশ যেতে পারছেন না, তাদের জন্য এই ঋণটি একটি আশীর্বাদ। এটি বিদেশ যাত্রার বিভিন্ন খরচ মেটাতে সহায়তা করে।
ঋণের উদ্দেশ্য:
- ভিসা ফি এবং প্রসেসিং খরচ।
- বিমান ভাড়া।
- বিদেশে যাওয়ার প্রাথমিক খরচ।
ঋণের পরিমাণ ও সুদের হার:
- পরিমাণ: সাধারণত ১ লক্ষ থেকে ৩ লক্ষ টাকা পর্যন্ত লোন অনুমোদন করা হয় (চুক্তির ভিত্তিতে পরিবর্তনশীল)।
- সুদের হার: খুবই কম, মাত্র ৯% সরল সুদ (Subsidized Rate)।
প্রধান নিয়ম ও যোগ্যতা:
- আবেদনকারীকে অবশ্যই বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে।
- বিদেশে চাকরির বৈধ ওয়ার্ক পারমিট বা ভিসা থাকতে হবে।
- আবেদনকারীর নামে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকে একটি সেভিংস একাউন্ট খুলতে হবে।
- বয়স সাধারণত ২১ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে হতে হবে।
- সরকার অনুমোদিত যেকোনো প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে সংশ্লিষ্ট কাজের উপর প্রশিক্ষণ বা দক্ষতার সার্টিফিকেট থাকতে হবে।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র (Checklist):
- পূরণকৃত আবেদন ফরম।
- আবেদনকারীর জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) এবং সদ্য তোলা ২ কপি ছবি।
- পাসপোর্টের ফটোকপি।
- বৈধ ভিসা বা ওয়ার্ক পারমিটের রঙিন ফটোকপি।
- প্রশিক্ষণের সনদপত্রের ফটোকপি।
- বর্তমান ঠিকানা যাচাইয়ের জন্য ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান/পৌরসভা মেয়র/ওয়ার্ড কাউন্সিলর কর্তৃক প্রদত্ত সনদ।
- দুইজন জামিনদার।
বিদেশ ফেরত কর্মীদের জন্য ঋণ (পুনর্বাসন ঋণ)
অনেক প্রবাসী দেশে ফিরে এসে কী করবেন তা নিয়ে দ্বিধায় ভোগেন। তাদের অর্জিত অভিজ্ঞতা ও অর্থকে কাজে লাগিয়ে দেশে একটি সম্মানজনক উদ্যোগ গড়ে তোলার জন্য প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক পুনর্বাসন ঋণ প্রদান করে।
ঋণের উদ্দেশ্য:
- ছোট বা মাঝারি আকারের ব্যবসা শুরু করা (যেমন: কৃষি খামার, মৎস্য চাষ, পশুপালন, দোকান, ওয়ার্কশপ ইত্যাদি)।
- বিদেশে অর্জিত দক্ষতার উপর ভিত্তি করে কোনো প্রকল্প চালু করা।
ঋণের প্রকারভেদ ও পরিমাণ:
- সাধারণ পুনর্বাসন ঋণ: সাধারণত ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত।
- বঙ্গবন্ধু অভিবাসী বৃহৎ পরিবার ঋণ: এটি একটি বিশেষায়িত ও বড় আকারের লোন, যা ২৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। এটি মূলত বড় প্রকল্পে বিনিয়োগের জন্য।
প্রধান নিয়ম ও যোগ্যতা:
- আবেদনকারীকে অবশ্যই বিদেশ ফেরত প্রবাসী হতে হবে (পাসপোর্টে আগমনের সিল বা অন্যান্য প্রমাণসহ)।
- যে প্রকল্পটি করতে চান, সে বিষয়ে একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ বা প্রজেক্ট প্রোফাইল তৈরি করতে হবে।
- আবেদনকারীর বয়স ২২ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে হতে হবে।
- উদ্যোক্তা হিসেবে প্রশিক্ষণ বা পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকলে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র :
- পূরণকৃত আবেদন ফরম।
- আবেদনকারীর জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) এবং সদ্য তোলা ২ কপি ছবি।
- পাসপোর্টের ফটোকপি (দেশে ফেরার প্রমাণসহ)।
- ব্যবসার পরিকল্পনা বা প্রজেক্ট প্রোফাইলের কপি।
- ব্যবসার স্থান নিজের হলে মালিকানার দলিল, আর ভাড়া হলে ভাড়ার চুক্তিপত্র।
- দুইজন জামিনদার।
জামিনদার সংক্রান্ত নিয়মাবলী
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের লোনের জন্য জামিনদার একটি বাধ্যতামূলক শর্ত।
- জামিনদার কারা হতে পারবেন? সাধারণত আবেদনকারীর পরিবারের সদস্য (বাবা-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী/স্বামী) অথবা আর্থিকভাবে সচ্ছল যেকোনো নিকটাত্মীয় বা সম্মানীয় ব্যক্তি।
- জামিনদারের কাগজপত্র: জামিনদারের জাতীয় পরিচয়পত্র, ছবি, ঠিকানার প্রমাণ এবং আর্থিক সচ্ছলতার প্রমাণ (যেমন—চাকরির সনদ, জমির দলিল বা ব্যবসার কাগজপত্র)।
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক লোন আবেদন প্রক্রিয়া (ধাপে ধাপে)
ফরম সংগ্রহ: আপনার নিকটস্থ প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের শাখা থেকে নির্দিষ্ট লোনের আবেদন ফরম সংগ্রহ করুন।
একাউন্ট খোলা: আবেদনকারীর নামে ব্যাংকে একটি সঞ্চয়ী হিসাব খুলতে হবে (যদি আগে থেকে না থাকে)।
ফরম পূরণ ও কাগজপত্র সংযুক্তকরণ: আবেদনপত্রটি নির্ভুলভাবে পূরণ করে উপরে উল্লেখিত সকল প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংযুক্ত করুন।
আবেদন জমা: পূরণকৃত ফরমটি ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার নিকট জমা দিন।
ব্যাংকের যাচাই-বাছাই: ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আপনার আবেদন, কাগজপত্র এবং জামিনদারের তথ্য যাচাই-বাছাই করবে। প্রয়োজনে তারা আপনার প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করতে পারে।
লোন অনুমোদন ও বিতরণ: সবকিছু সঠিক থাকলে আপনার লোন অনুমোদন হবে এবং আপনার ব্যাংক একাউন্টে টাকার পরিমাণ জমা করে দেওয়া হবে।
সাধারণ কিছু প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
প্রশ্ন ১: আমি কি জামিনদার ছাড়া লোন পাবো?
উত্তর: না, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী সকল প্রকার লোনের জন্য এক বা একাধিক জামিনদার বাধ্যতামূলক।
প্রশ্ন ২: সরকারি প্রশিক্ষণ ছাড়া কি বিদেশ যাওয়ার লোন পাওয়া যায়?
উত্তর: সাধারণত পাওয়া যায় না। কারণ, সরকার চায় দক্ষ কর্মীরাই যেন বিদেশে যান। তাই সরকার অনুমোদিত কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ থাকাটা প্রায় বাধ্যতামূলক।
প্রশ্ন ৩: লোন পরিশোধের মেয়াদ কতদিন?
উত্তর: লোনের ধরন অনুযায়ী পরিশোধের মেয়াদ ভিন্ন হয়। অভিবাসন ঋণ সাধারণত ২-৩ বছরের মধ্যে এবং পুনর্বাসন ঋণ ৫-১০ বছরের মধ্যে মাসিক বা ত্রৈমাসিক কিস্তিতে পরিশোধ করতে হয়।
- আরও পড়ুনঃ সহজ কিস্তিতে লোন
উপসংহার
সঠিক নিয়ম মেনে আবেদন করলে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের লোন আপনার বিদেশ যাত্রার পথকে মসৃণ করতে পারে অথবা দেশে ফিরে একটি সুন্দর ও সম্মানজনক ভবিষ্যৎ গড়তে প্রধান সহায়ক হতে পারে। এটি শুধু একটি ঋণ নয়, এটি প্রবাসীদের জন্য বাংলাদেশ সরকারের একটি নির্ভরতার প্রতীক।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই আর্টিকেলের সকল তথ্য সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে লেখা। ব্যাংক যেকোনো সময় তাদের নিয়ম ও শর্তাবলী পরিবর্তন করার অধিকার রাখে। তাই আবেদন করার পূর্বে অবশ্যই প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের ওয়েবসাইট বা আপনার নিকটস্থ শাখা থেকে সর্বশেষ তথ্য পুনরায় যাচাই করে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো।